“আমার পা রীতিমতো কাঁপছিল তখন। ম্যাচশেষে সমর্থকেরা যখন আমার নামে গান গাইছিল, আমার মধ্যে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনার ঢেউ উঠেছিল। তবুও আমি দাঁড়িয়েছিলাম গ্যালারির সামনে, শুনতে চেয়েছিলাম তাদের গান।”
– জুড বেলিংহাম, রিয়াল মাদ্রিদ-গেতাফে ম্যাচের পরে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সমর্থকদের ‘হেই জুড’ গান গাওয়া প্রসঙ্গে।
প্রথম চার ম্যাচের পারফরম্যান্স দিয়েই হয়তো পুরোপুরি বিচার করে ফেলা উচিত নয়, উচিত নয় অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করাও। তবে জুড বেলিংহাম যা শুরু করেছেন, তাতে সবাই বাধ্য হয়েছেন নড়েচড়ে বসতে। লা লিগার প্রথম চার ম্যাচেই পাঁচ গোল আর এক অ্যাসিস্ট, এই ধারা অব্যাহত রাখলে তো পিচিচিটাই জিতে নেবেন এই মিডফিল্ডার!
অথচ, মাত্র এই গ্রীষ্মেই বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ১০৩ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদ দলে টেনেছে জুড ভিক্টর উইলিয়াম বেলিংহামকে। ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুলের মতো ক্লাবগুলোর আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বেলিংহাম বেছে নিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদকেই। মাদ্রিদের আগ্রহও ছিল পুরোমাত্রায়, ডর্টমুন্ডে আলো ছড়ানো এই মিডফিল্ডারকে অনেক দিন ধরেই ‘পাখির চোখ’ করেছিল তারা। তবে ডর্টমুন্ডে নয়, মাত্র ২০ বছর বয়সী এই ইংরেজ মিডফিল্ডারের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ইংরেজ ক্লাব বার্মিংহ্যাম সিটিতে। আর সেখানে তার পারফরম্যান্স এতটাই দুর্দান্ত ছিল, ডর্টমুন্ডের উদ্দেশ্যে ক্লাব ছাড়ার সাথে সাথে বেলিংহামের ২২ নম্বর জার্সিটাকেও অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। অথচ বেলিংহামের বয়স তখন মাত্র ১৭!
একবার ভাবুন পুরো ব্যাপারটা। কৈশোর পেরোনোর আগেই আপনি দেশ ছাড়লেন। এরপর জার্মানিতে আপনি এমন একটা ক্লাবে গেলেন, যাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম বায়ার্ন মিউনিখ। সেই ক্লাবেই আপনি সমর্থকদের হৃদয় জিতলেন, আপদকালীন অধিনায়কত্ব করলেন। এরই মধ্যে দেশের হয়ে আপনার অভিষেক হয়ে গেল, বিশ্বকাপে আপনি দেশের জার্সিতে মাঠে নামলেন। এরপর শতাধিক মিলিয়ন ইউরো খরচ করে আপনাকে দলে টানলো সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্লাবটাই। রিয়াল মাদ্রিদের শুভ্র জার্সি পরে আপনি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খেলতে নামছেন, অথচ জীবনে মাত্র বিশটি বসন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আপনার।
চাপে তো এভাবেই মূল্যহীন কয়লা রূপান্তরিত হয় অমূল্য হীরায়!
তবে বেলিংহামকে দেখলে অবশ্য খুব চাপে আছেন বলে মনে হয় না। মাঠের ফুটবলে জাদু দেখানো তার কাছে খুবই সহজ কাজ, বরং মাঠের বাইরে তাকে নিয়ে দর্শকদের উচ্ছ্বাস দেখলেই তিনি কিঞ্চিৎ স্নায়ুচাপে ভোগেন। অবশ্য তেমনটাই তো হওয়ার কথা, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর শুভ্র-সমুদ্রের সাথে যে নিজেকে খুব বেশি পরিচিত করে নেওয়ার সুযোগটাই তিনি পাননি এখনো!
আপাতত গেতাফের বিপক্ষের ঐ ম্যাচেই ফেরা যাক।
লা লিগায় নিজেদের প্রথম ম্যাচ হলেও, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে এটিই ছিল মৌসুমের প্রথম ম্যাচ। এই ম্যাচেই শুরুতে গোল হজম করে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ, দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচে সমতা ফেরান হোসেলু। তবে খেলা যখন নব্বই মিনিট পেরিয়ে গড়ালো যোগ করা সময়ে, মৌসুমের প্রথম পয়েন্ট হারানোকে ভবিতব্যই মনে হচ্ছিলো কার্লো আনচেলত্তির শিষ্যদের জন্য।
তখনই বেলিংহাম-ম্যাজিক!
লুকাস ভাসকেজের নেওয়া শটটা গেতাফে গোলরক্ষক ডেভিড সোরিয়ার জন্য আটকানো সহজই ছিল। পুরো ম্যাচে অসাধারণ কিপিং করা সোরিয়া নিজের শরীর বরাবর আসতে থাকা অমন সাধারণ শটটা ঠেকাতে পারবেন না, তা বোধহয় ভাসকেজ নিজেও ভাবেননি।
তবে বেলিংহাম হয়তো ভেবেছিলেন। ভাসকেজের শটের প্রায় সাথে সাথে তাই তিনিও ছুটতে শুরু করেছিলেন গোলরক্ষকের দিকে, সামান্যতম ভুলচুককেও তো কাজে লাগাতে হবে!
সেই ভুলটাই করে বসলেন সোরিয়া। প্রথম সুযোগেই হাতে নিতে পারলেন না বলটা, তার হাত থেকে ছিটকে গিয়ে পড়লো বেলিংহামের সামনে। বেলিংহাম কোনো ভুল করলেন না। সহজ ট্যাপ-ইন করে রিয়াল মাদ্রিদকে এনে দিলেন মহামূল্যবান তিনটা পয়েন্ট।
এটা তো একটা উদাহরণ মাত্র। লা লিগার শুরুর চার ম্যাচেই জয় পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, এজন্য বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য বেলিংহামেরও। অভিষেক ম্যাচে অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে গোল পেয়েছেন, দ্বিতীয় ম্যাচে আলমেরিয়ার বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা রিয়াল মাদ্রিদকে ৩-১ ব্যবধানে জিতিয়েছেন জোড়া গোল করে। তৃতীয় ম্যাচে ৮১ মিনিটে গোল করে এনে দিয়েছেন কষ্টার্জিত জয়, এরপর তো গেতাফের বিপক্ষের ঐ ম্যাচ। এরপরও রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা বেলিংহামকে না ভালোবেসে পারেন!
তবে রেকর্ডের পাতা ঘাঁটলে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, বেলিংহামই একুশ শতকে লা লিগায় নিজের প্রথম চার ম্যাচেই গোল করা প্রথম খেলোয়াড় নন। এর আগে ২০০৯-১০ মৌসুমে স্লাতান ইব্রাহিমোভিচ আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এই কীর্তিতে নিজেদের নাম লিখিয়েছিলেন, সেস্ক ফ্যাব্রিগাস এই কীর্তি গড়েছিলেন ২০১১-১২ মৌসুমে। একুশ শতকে লা লিগায় দ্রুততম পাঁচ গোলের তালিকায়ও বেলিংহাম যৌথভাবে দুইয়ে। তালিকার শীর্ষে থাকা রাদামেল ফ্যালকাওয়ের প্রয়োজন হয়েছিল ৩ ম্যাচ, ২০১১ সালে এই রেকর্ডে নিজের নাম লিখেছিলেন কলম্বিয়ান তারকা। ৪ ম্যাচ খেলে ৫ গোলের মাইলফলকে পৌঁছেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, রবার্ট লেওয়ানডস্কি আর জুড বেলিংহাম – যথাক্রমে ২০০৯, ২০২২ আর ২০২৩ সালে।
কিন্তু তথাকথিত ফরোয়ার্ড না হওয়া সত্ত্বেও জুড বেলিংহামের এই সাফল্যের রহস্য কী?
বেলিংহামের সাফল্যের পেছনে
বেলিংহামের সাফল্যের পেছনে আহামরি কোনো রহস্য নেই। নিজেদের পায়ে বল থাকা অবস্থায় বেলিংহাম কার্যত একজন ফরোয়ার্ড হয়ে উঠছেন, খেলছেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র আর রদ্রিগোর পাশে তৃতীয় ফরোয়ার্ড হিসেবে।
ওপরের ছবিতে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, বেলিংহাম মাঠের সেই সব জায়গায়ই বেশি বল পাচ্ছেন, যেখান থেকে গোল করার সুযোগ তৈরি হয়। এমনকি একজন মিডফিল্ডার হয়েও মাঝমাঠের বৃত্তের তুলনায় প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে তিনি বলে বেশি স্পর্শ করছেন।
রিয়াল মাদ্রিদে বেলিংহামের ভূমিকাটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। দুই উইঙ্গার ভিনিসিয়াস জুনিয়র আর রদ্রিগোর কিছুটা পেছনে খেলছেন তিনি, একজন ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে। ভিনিসিয়াস জুনিয়র অবশ্য চোটে পড়েছেন সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে, তার জায়গাটা নিয়েছেন হোসেলু।
মাঝমাঠের দায়িত্ব কমিয়ে দেওয়ার জন্য বেলিংহামের পেছনে রাখা হচ্ছে তিনজন মিডফিল্ডারকে। অঁরেলিয়ে চুয়ামেনি রয়েছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে, বাকি দুটো পজিশনের জন্য লড়ছেন এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, ফেডেরিকো ভালভার্দে, টনি ক্রুস আর লুকা মদরিচ। কামাভিঙ্গা আর ভালভার্দেকেই দিয়েই অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাচের শুরুটা করছেন কার্লো আনচেলত্তি, ক্রুস আর মদরিচ নামছেন বিরতির পরে। তবে যারাই থাকছেন মাঠে, নিশ্চিত করছেন, বেলিংহাম যেন স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের খেলাটা খেলতে পারেন, প্রয়োজনে ফরোয়ার্ড হয়ে গোলও করতে পারেন।
বেলিংহামও সেই কাজটা করছেন দারুণভাবেই। লা লিগার প্রথম চার ম্যাচেই প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়েছেন পাঁচবার, যেখানে গত মৌসুমে বুন্দেসলিগার ৩১ ম্যাচে তার গোল আটটা। আর চলতি মৌসুমের এই পাঁচটা গোল আবার এসেছে মাত্র আটটা শট থেকে, যেখানে তার এক্সপেক্টেড গোল (xG) মাত্র ১.৮। অর্থাৎ নিজের ‘এক্সপেক্টেড গোল’-এর তুলনায় ৩.২ সংখ্যক বেশি গোল পেয়েছেন বেলিংহাম, আর ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগে গোল আর এক্সজির এত বেশি ব্যবধান রাখতে পারেননি অন্য কেউ।
আর শুধু গোলই নয়, বেলিংহাম অর্জন করে নিয়েছেন কোচ কার্লো আনচেলত্তির বিশ্বাস আর ভরসাও। এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে সর্বমোট ৩৫১ মিনিট খেলেছেন বেলিংহাম, শুধুমাত্র ডেভিড আলাবা খেলেছেন তার চেয়ে বেশি সময় (৩৬০ মিনিট)। এই চার ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের মোট গোলসংখ্যা আট, যার অর্ধেকের বেশি এসেছে বেলিংহামের পা থেকে। তিন ফরোয়ার্ড রদ্রিগো, ভিনিসিয়াস আর হোসেলুর পা থেকে এসেছে একটি করে গোল। সব মিলিয়ে, করিম বেনজেমার রেখে যাওয়া গোল করার জুতোটাই যেন পরে নিয়েছেন জুড বেলিংহাম, বুঝতেই দিচ্ছেন না তার অভাবটা!
তবে বেলিংহাম শুধুই একজন গোলস্কোরার নন। পাঁচ গোলের পাশাপাশি বেলিংহাম তৈরি করেছেন নয়টি সুযোগও, রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে টনি ক্রুস (১১) ব্যতীত তার চেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করতে পারেননি আর কেউ। সেট পিসগুলো বাদ দিলে, বেলিংহাম আর ক্রুস অবস্থান করছেন সমানে সমানে, নয়টি করে বড় সুযোগ তৈরি করে।
আক্রমণের ধারা তৈরিতেও বেলিংহাম দারুণ পারদর্শী। প্রথম চার ম্যাচ শেষে, বার্সেলোনার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং যুক্ত ছিলেন মোট ৩০টি আক্রমণের ক্ষেত্রে, এরপরই ২৮টি আক্রমণে অংশ নিয়ে বার্সেলোনার ডিফেন্ডার জুলস ক্যুন্দের সাথে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন জুড বেলিংহাম। বেলিংহামের ২৮টি আক্রমণের বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট শট নিয়েছেন ৮টি, তৈরি করেছেন ৮টি সুযোগ, আর শট নেওয়ার বিল্ড-আপে যুক্ত ছিলেন ১২টি ক্ষেত্রে।
পায়ে বল রাখার ক্ষেত্রেও বেলিংহাম বেশ ভালো। যদিও তার সফল পাসের শতকরা হাত সতীর্থ টনি ক্রুস (৯৪.৩%), অঁরেলিয়ে চুয়ামেনি (৯২.৮%), এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা (৯০.৯%), ফেডেরিকো ভালভার্দে (৯০.৭%) বা লুকা মদরিচদের (৯০.০%) মতো ততটা ভালো নয়, তবে মাঠের অপেক্ষাকৃত ওপরের দিকে খেলেও, যেখানে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের ঘনত্ব বেশি, ৮৮.৭% সফল পাস দেওয়াটা নিতান্ত চাট্টিখানি কথা নয়।
তার আক্রমণের দিকটাই সবার নজরে পড়ছে স্বাভাবিকভাবে, কিন্তু বেলিংহাম আলো ছড়াতে জানেন রক্ষণেও। বুন্দেসলিগায় সর্বশেষ মৌসুমে ৭৬টা ট্যাকেল অ্যাটেম্পট করেছেন তিনি, সফল হয়েছেন ৫৫.৩% ক্ষেত্রে। লা লিগায় অবশ্য সেই সংখ্যাটা এখনো বেশ কম, প্রথম চার ম্যাচে মাত্র তিনবার ট্যাকল করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি, জিতেছেন অবশ্য দুই ক্ষেত্রে।
মাদ্রিদের শুভ্র পোশাকে বেলিংহাম ইতিমধ্যে সবার হৃদয় জিতে নিয়েছেন। তবে আক্রমণের পাশাপাশি রক্ষণের কাজেও যদি ভালো করতে পারেন তিনি, সেক্ষেত্রে তিনিই হবেন রিয়াল মাদ্রিদের জন্য একজন আদর্শ মিডফিল্ডার।
করিম বেনজেমার অনুপস্থিতিতে কার্লো আনচেলত্তি চার মিডফিল্ডারকে খেলাচ্ছেন ডায়মন্ড আকৃতিতে, আর সেই মিডফিল্ডের সবার সামনের হীরক খণ্ডটির নাম জুড বেলিংহাম। অভিষেকের পরের শুরুর ম্যাচগুলোতেই তিনি নিজের জাতটা চিনিয়ে দিয়েছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি এসেছেন এই সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর রাজা হতে। এখন শুধুই সামনে এগিয়ে চলার পালা, আর নতুন রাজার অগ্রযাত্রায় মাদ্রিদ-সমর্থকেরা কি খুশি না হয়ে পারেন!
[সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত]