“আপনি যদি তার সামনে ওয়ান-অন-ওয়ানে মুখোমুখি দাঁড়ান, আপনার সামনে তখন একটাই করণীয়: প্রার্থনা করা।”
-থিয়েরি অঁরি
বেলজিয়াম জাতীয় দলের সহকারী ম্যানেজার হওয়ায় থিয়েরি অঁরি ভালোভাবেই চিনতেন জেরেমি ডোকুকে, ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেওয়ার আগেই তাই ‘সতর্কবাণী’ প্রদান করেছিলেন প্রতিপক্ষদের উদ্দেশ্যে। অঁরিও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন, বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা কোচের অধীনে আরো বেশি শাণিত হয়ে উঠবেন এই উইঙ্গার।
হয়েছেও ঠিক সেটাই। প্রিমিয়ার লিগে মাত্র সাড়ে তিন মাস সময়েই ডোকু ছড়াচ্ছেন আগামীর তারকা হওয়ার প্রতিশ্রুতি। তবে সেরা পারফরম্যান্সটা এসেছে নিঃসন্দেহে বোর্নমাউথের বিপক্ষের ম্যাচে, এক গোল আর চার অ্যাসিস্টে ডোকু নিজের নাম লিখেয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে এক ম্যাচে পাঁচটি গোল কন্ট্রিবিউশনে। এখানেই শেষ নয়, ঐ ম্যাচেই, মাত্র ২১ বছর ১৬১ দিন বয়সে, কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে এক ম্যাচে চারটা অ্যাসিস্টও করেছেন তিনি। এর আগে আরো আটজন খেলোয়াড় প্রিমিয়ার লিগের এক ম্যাচে চার অ্যাসিস্ট করেছেন বটে, তবে তাদের কারোর বয়সই ডোকুর চেয়ে কম ছিল না।
একই সাথে ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগে নিজের প্রথম আট ম্যাচে সাতটা গোলে সরাসরি অবদান রেখেছেন ডোকু, যার মধ্যে পাঁচটাই অ্যাসিস্ট, যেখানে রেঁনের হয়ে লিগ আঁতে গত দুই মৌসুম মিলিয়ে তার মোট অ্যাসিস্ট ছিল চারটি।
ডোকুর এই চমৎকার শুরুর সাথে অনেকেই মিল খুঁজে পাচ্ছেন সিটির সাবেক ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড গ্যাব্রিয়েল জেসুসের, প্রথম আট ম্যাচে সাতটা গোলে সরাসরি অবদান রেখেছিলেন তিনিও। ডোকুর স্বদেশী কেভিন ডি ব্রুইনার ক্ষেত্রেও সংখ্যাটা একই। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগের প্রথম আট ম্যাচে গোল কন্ট্রিবিউশনে ডোকুর ওপরে রয়েছেন মাত্র চারজন, আর্লিং হাল্যান্ড (১৭), সার্জিও আগুয়েরো (১১), রবিনহো (৮) এবং ডেভিড হোয়াইট (৮)।
তরুণ খেলোয়াড়রা ম্যানসিটিতে আসেন, এরপর পেপ গার্দিওলার দারুণ কোচিংয়ে নিজেদের পরিশীলিত করেন, ধীরে ধীরে প্রথম একাদশে নিজেদের জায়গা পাকা করেন, এগুলো ফুটবলপ্রেমীদের জন্য নতুন কোন দৃশ্য নয়। তবে এত কম বয়সে দলে এত দারুণ প্রভাব বিস্তার করা, সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ম্যানচেস্টার সিটিতে একটা বিরল দৃশ্যই বটে। হ্যাঁ, ডোকুর বয়স এখনো বাইশ পূর্ণ হয়নি, প্রিমিয়ার লিগে তার ক্যারিয়ার কেবল শুরু হলো, তবুও, সকালের সূর্যই তো দিনের পূর্বাভাস দেয়!
আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, গুরু পেপ গার্দিওলাই তো শিষ্যের প্রতিভা আর প্রিমিয়ার লিগে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতায় মুগ্ধ।
“আমি চমকে গিয়েছি কি না? সত্যি বলতে, একটু চমকে গিয়েছি তো বটেই। হ্যাঁ, তাকে নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। তার পায়ে বল গেলেই দর্শকদের জন্য দৃষ্টিসুখকর একটা ব্যাপার ঘটে। বল নিয়ে যখন সে সবাইকে কাটিয়ে দৌড় দেয়, সবারই ভালো লাগে, আমি নিজেও এর বাইরে নই। মনে হতে থাকে যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে, এবং এরপর সত্যিই সেটা ঘটে।”
-পেপ গার্দিওলা, ম্যানেজার, ম্যানচেস্টার সিটি
তবে ডোকুর ট্র্যাক রেকর্ড দেখলে গার্দিওলার চমকিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। ড্রিবলিং করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলাতেই যত আনন্দ এই উইঙ্গারের, তিনি নিজেও সেটা স্বীকার করেছিলেন এক বছর আগেই।
“আমার বয়স যখন ষোল, তখন থেকেই আমি চাইতাম প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ঘুম হারাম করে দিতে। আমি চাইতাম, যেন আমার বিরুদ্ধে খেলার পরে সে আর রাতে ঘুমাতে না পারে, সে যেন আমাকে রীতিমতো ঘৃণা করে।”
-জেরেমি ডোকু, উইঙ্গার, ম্যানচেস্টার সিটি
ডোকুর সেই চাওয়া কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে, অন্তত সর্বশেষ ম্যানচেস্টার ডার্বিতে তো বটেই। ডোকুকে ‘ঘৃণা’ করতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অ্যান্টনির সময় লেগেছিল পাঁচ মিনিটেরও কম। তিন সেকেন্ডের ব্যবধানে দু’বার অ্যান্টনিকে ড্রিবল করার পর ঠিকই হতাশা প্রকাশ করেছিলেন অ্যান্টনি, যেন লাথি মারতে চেয়েছিলেন ডোকুকে।
তবে এটাও সত্য, রেঁনের হয়ে গত মৌসুমের তুলনায় ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে এই মৌসুমে ডোকুর টেক-অনের পরিমাণ কমেছে বেশ। গত মৌসুমে ম্যাচ প্রতি ৬.৭টা টেক-অন সম্পন্ন করতেন ডোকু, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। এই মৌসুমের ম্যাচপ্রতি ৫.৩টা টেক-অনও ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের সর্বোচ্চই, তবে টেক-অনের সংখ্যার পরিবর্তনটা দৃশ্যমান।
ড্রিবল করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদেরকে ছিটকে ফেলার সুযোগ থাকলে ডোকু সেই সুযোগটা গ্রহণে পিছপা হন না কখনোই। যদিও এই মৌসুমে তার টেক-অন অ্যাটেম্পটে সফলতার হার অপেক্ষাকৃত কম, মাত্র ৫৮.১ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রিমিয়ার লিগের সেরা ড্রিবলার আদামা ত্রাওরের ২০২১-২২ মৌসুমের পরিসংখ্যানের চেয়ে ডোকু একটু পিছিয়েই আছেন এখনো। ঐ মৌসুমে ১৪৮টা অ্যাটেম্পটের মধ্যে ১০৭ ক্ষেত্রে সফল হন ত্রাওরে, শতাংশের হিসাবে যা ৭৪.৮ শতাংশ। তবে এটাও সত্য, ত্রাওরের মতো ‘বেবি অয়েল’ এখনো ব্যবহার শুরু করেননি ডোকু।
পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটিতে এর আগে ডোকুর মতো দারুণ উইঙ্গার আসেননি, বিশেষ করে ড্রিবলিংয়ে ডোকু অতুলনীয়। টেক-অনে ডোকুর সাথে পাল্লা দিতে পারেন কেবল লেরয় সানে আর রাহিম স্টার্লিং। ২০১৬-১৭তে, সিটির ডাগআউটে গার্দিওলার প্রথম মৌসুমে স্টার্লিং-সানের ড্রিবলিং-ঝলক দেখা গিয়েছিল। প্রতি নব্বই মিনিটে ৬.১টা টেক-অনের অ্যাটেম্পট করেছিলেন লেরয় সানে, সফল হয়েছিলেন গড়ে ২.৭ ক্ষেত্রে। স্টার্লিং অ্যাটেম্পট করেছিলেন কিছুটা কম (প্রতি নব্বই মিনিটে ৫.৭টা), তবে সাফল্যের পরিমাণ তারই বেশি (প্রতি নব্বই মিনিটে ২.৮টা)। কিন্তু তবুও, ডোকুর এই মৌসুমের গড় টেক-অনের চেয়ে পিছিয়ে আছেন দুজনেই।
তবে গার্দিওলার কোচিংয়ের একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দারুণ সব ড্রিবলারকে যে গার্দিওলা দলে পাননি, এমন নয়, কিন্তু গার্দিওলার অধীনে ড্রিবলাররা ড্রিবলিংয়ের ঝুঁকি নেওয়ার বদলে বল নিজেদের পায়ে রাখার দিকেই বেশি মনোযোগী হন। ড্রিবলিং করে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বক্সের দিকে ঢুকে পাস দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায় তাদের মধ্যে। জ্যাক গ্রিলিশের ব্যাপারটাই ধরা যাক। অ্যাস্টন ভিলায় নিজের শেষ মৌসুমে গ্রিলিশ প্রতি নব্বই মিনিটে ৪.৫টা টেক-অন করতেন, যেটা তার ম্যানচেস্টার সিটি ক্যারিয়ারে নেমে এসেছে ৩.৫-এ। এই মৌসুমে সেটা আরো কমেছে, ২.১টা টেক-অন তিনি করছেন চলতি মৌসুমে। তবে ডোকু যেভাবে প্রতিপক্ষকে নাচিয়ে ছাড়ছেন তার ড্রিবলিং দিয়ে, গার্দিওলা হয়তো এক্ষেত্রে একটু নমনীয় হলেও হতে পারেন, হয়তো নিজের মতো করে খেলার স্বাধীনতা দেবেন ডোকুকে।
আর শুধু প্রতিপক্ষকে টেক-অন করাই নয়, পায়ে বল নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিতেও পারদর্শী ডোকু। এবারের মৌসুমে প্রগ্রেসিভ বল ক্যারির সংখ্যাতেও (প্রতি নব্বই মিনিটে ১৭.২টা) তাকে পেছনে ফেলতে পারেননি প্রিমিয়ার লিগের কোন মিডফিল্ডার বা ফরোয়ার্ড। এই প্রগ্রেসিভ ক্যারিতে গড়ে প্রতি নব্বই মিনিটে ২১২ মিটার অতিক্রম করেন ডোকু, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে খেলা ফরোয়ার্ডদের মধ্যে শুধুমাত্র ওসমান ডেম্বেলে (প্রতি নব্বই মিনিটে ২১৯ মিটার) এগিয়ে রয়েছেন ডোকুর তুলনায়।
গার্দিওলার পরিকল্পনাতেও ডোকু রয়েছেন ভালোভাবেই। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে সিটির খেলা ১৩টা ম্যাচের প্রতিটাতেই খেলেছেন ডোকু। এই ১৩ ম্যাচের মাত্র ৭টিতে তিনি শুরুর একাদশে ছিলেন, আর বদলি হিসেবে ডোকু যেন আরো বেশি কার্যকর। প্রতিপক্ষের ক্লান্ত পায়ের সুবিধা নিতেই উজ্জীবিত ডোকুর বল ক্যারি করার সামর্থ্যকে কাজে লাগান পেপ গার্দিওলা।
চ্যাম্পিয়নস লিগে ইয়াং বয়েজের বিপক্ষের ম্যাচটাই ধরা যাক। ছয়টা টেক-অন অ্যাটেম্পটের ছয়টাতেই সফল ছিলেন ডোকু, অথচ অতিরিক্ত সময়সহ খেলেছেন মাত্র ১৪ মিনিট। সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে, বদলি হিসেবে নেমে গড়ে প্রতি নব্বই মিনিটে ডোকু ১৭.৬টা টেক-অন সম্পন্ন করেন, আর প্রগ্রেসিভ ক্যারিতে অতিক্রম করেন ২৫৯ মিটার। অপর দিকে শুরুর একাদশে থাকলে তিনি গড়ে প্রতি নব্বই মিনিটে সম্পন্ন করেন ৭.৯টা টেক-অন, আর প্রগ্রেসিভ ক্যারিতে পাড়ি দেন ১৭৬ মিটার। স্বাভাবিকভাবেই, বদলি হিসেবেই ডোকুকে বেশি পছন্দ গার্দিওলার।
সব কথার শেষ কথা, ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে শুরুর মৌসুমের মাত্র ১৩টা ম্যাচ দিয়ে কোনোভাবেই জেরেমি ডোকুর ভবিষ্যৎ বিচার করে ফেলা উচিত না, তবে এখন পর্যন্ত লক্ষণগুলো যথেষ্ট শুভ। আর তরুণ খেলোয়াড়দের পরিচর্যার ক্ষেত্রে যেহেতু পেপ গার্দিওলার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে, ডোকুর খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। তাই এটা নিশ্চিত, সব মিলিয়ে ম্যানচেস্টার সিটি-ভক্তদের, আর মোটা দাগে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য দারুণ সময়ই অপেক্ষা করছে সামনে।
[সকল তথ্য ১২ নভেম্বর ২০২৩ অবধি]